নয়ন সমুখে তুমি নাই নয়নেরই মাঝ খানে নিয়েছ যে ঠাই—এই গানটি যখনই কোথাও শুনি তখনই বাবার কথা খুব খুব মনে পড়ে । বাবার অভাব প্রতিটি কলিতে কলিতে টের পাই । আমার বাবা ছিল আমার একজন প্রিয় বন্ধু, শিক্ষক, আমার পুজনীয়, আমার অনুসরনীয় ও শ্রদ্ধার পাত্র । তিনি ছাতার মত সব সময় আমাকে ছায়া দিয়েছেন নিরাপত্তা দিয়েছেন । সবার বাবার মত আমার বাবাও আমার পরম গর্ব । আমি আজ যা কিছু অর্জন করতে পেরেছি তা সবই বাবার অবদান । যতটুকু অর্জন করতে পারিনি তা আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা । কারন কখনে কখনো আমি আমার গোয়ার্তুমির কারনে বাবার সব কথা রাখতে পারিনি বা শুনিনি । আমি বাবার সর্বকনিষ্ট সন্তান । আমার মা মোট আটটি সন্তানের জন্মদাত্রী । যার সবই ছিল পুত্র সন্তান । আমার জন্মের পুর্বেই আমার দু ভাই এ পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছেন । আমার ইমিডিয়েট বড় জন আমার বয়স যখন চার বছর তখন কলেরা নামক মহামারীতে মৃত্যু বরন করেন । শেষ পর্যন্ত আমরা পাঁচ ভাই বেচে ছিলাম । সর্ব কনিষ্ট বলে আমিই পেয়েছি দীর্ঘ সময় বাবার সান্নিধ্য । আমি যখন এইচ এসসিতে পড়ি তখনও আমাকে বাবা মায়ের মাঝ খানে শুয়ে ঘুমুতে হয়েছে । মায়ের কাছে শুনেছি আমার জন্মের আগে বাবাসহ বাড়ীর সকলের ইচ্ছে ছিল আমি যেন মেয়ে সন্তান হিসেবে জন্মাই । কারন আমাদের পরিবারে এর আগে আমার এক চাচাতো বোন ছাড়া আর কোন মেয়ে সন্তান ছিল না । পরিবারের প্রতিটি মানুষ মেয়ে সন্তানের জন্য লালায়িত ছিল । আমার জন্ম হয়েছিল নাকি পহেলা বৈশাখের অতিপ্রত্যুশে বাংলা নতুন বছরের সূর্যোদয়ের কালে । গ্রামে গ্রামে তখন নতুন বর্ষ বরনের ধুম । কিন্তু আমি ছেলে সন্তান হিসেবে জন্ম নেয়ায় আমাদের বাড়ীর সবার মন ভার । মা, বাবা তখন অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন । মা তার নাড়ীছেড়া ধন ফেলেদিতে পারেন নি বলেই বেচেছিলাম । চারমাস বয়স পর্যন্ত অনেকটা অযত্নে অবহেলায় আমি বড় হতে লাগলাম । বাবা নাকি দীর্ঘ প্রায় চারমাস আমার মুখ পর্যন্ত দেখেন নি । এমন কি আমাকে পাশের বাড়ীর একটি মেয়ে সন্তানের সাথে বদল করার প্রক্রিয়াও প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছিল বলে মা এর কাছ থেকে পরে জেনেছি । বাদ সেধেছিলেন শুধু আমার মা আর চাচাতো বোন টি । যিনি শৈশবেই বাবা মাকে হারিয়ে আমার মায়ের কাছেই বড় হয়ে উঠেছেন । পাশের বাড়ীর চাচী প্রায় সময়ই আমাদের বাড়ী আসতেন আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে আদর করতেন । আমার ছেলেটা কোথায় বলে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করতেন । ঘরে নতুন কোন পিঠাপুলি তৈরী হলে বা গাছের নতুন ফলটা আমায় এনে নিজ হাতে খাওয়াতেন । আমি তার আদরে অভিভুত হতাম । উনাদের উঠানে গেলে কোলে তুলে নিয়ে আমার কচিগালে চুমুই চুমুই ভরিয়ে দিতেন । পরে জেনেছি তিনিই সেই মহিলা যার মেয়ে সন্তানের সাথে আমার বদল হবার কথা ছিল । আমার বয়স যখন সাত আট বছর হবে তখন তার ঘরে একটি পুত্র সন্তান জন্মেছিল । কিন্তু তারপরও তিনি আমাকেই তার বড় সন্তান হিসেবে স্নেহ করতেন । যা তিনি আমৃত্যূ করে গিয়েছেন । আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখনো বাড়ী গিয়েছি শুনতে পেলেই তিনি ছুটে আসতেন । আমার মাথাটা বুকে নিয়ে আদর করতেন । হায়রে মাতৃহৃদয় । শেষের দিকে আমায় প্রায়ই বলতেন –বাবারে আমি তোমায় আদর করি বলে তুমি কি রাগ কর ? আমি বলতাম না চাচী রাগ করবো কেন আপনিতো আমার মায়েরই মত । উনাকে দেখে আমি শিখেছি মাতৃত্ব কি জিনিষ । মা এর মন সন্তানের জন্য কতটা কাঙ্গাল । আমি মা আর বোনের কোলেই চার মাস পর্যন্ত লালন পালন হয়ে আসছিলাম । চার মাস বয়সের সময় হঠাৎ আমার নাকি বড় রকমের নিমুনীয়া হয়েছিল । আমার বাচার আর কোন আশা নেই । কেউ ডাক্তার বৈদ্যও ডাকতে বাবাকে বলতে সাহস পাচ্ছিল না । মা লোক মারফত খবর পাঠালেন আমার খালার কাছে । পরদিন সকালে খালা খালু এক বৈদ্য নিয়ে হাজির হলেন । বাবা যত রাগীই হউন না কেন খালা খালুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন । বাবা খালু খালাদের বৈদ্য নিয়ে আসতে দেখে ভীষন লজ্জা পেয়েছিলেন । আমার সে খালা ছিলেন আবার পাচটি কন্যা সন্তানের জননী । যাক সে যাত্রা যমের সাথে যুদ্ধ করে বৈদ্যবাবাজির চিকিৎসায় আমি বেচে উঠলাম । বাবা আমার মুখ দেখলেন । বাবা নাকি বেশ কিছুক্ষন আমার মুখ পানে চেয়ে থেকে মায়ের কাছ থেকে আমায় বুকে তুলে নিয়ে ছিলেন । সেই যে আমি বাবার বুকে ঠাই নিয়েছি আমৃত্যু তিনি আমায় বুকে আগলে রেখেছিলেন । সকাল সন্ধ্যা সারাক্ষন আমি বাবার হত ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি তার এ বন্ধু ও বন্ধুর বাড়ী । বাবা ছিলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম । নামাজে যাবার সময় আমাকে হাত ধরে মসজিদে নিয়ে যেতেন আবার নামাজ শেষে বাড়ী ফিরতেন । দুরে জমি তদারকিতে যাবার কালে মাকে বার বার আমার দিকে খেয়াল রাখার জন্য তাগাদা দিয়ে তবেই বের হতেন । বাবার আচরন দেখে মা মাঝে মাঝে হাসতেন । কিন্তু বাবাকে কিছু বুঝতে দিতেন না । বাবা ছিলেন বেশ রাগী প্রকৃতির । ফলে কেউ বাবার সামনে কিছু বলতে সাহস পেত না । আমি দেখেছি মা কোন দিন বাবার চোখে চোখ তুলে কথা বলতেন না ্ অথচ তাদের মাঝে কিন্তু কোন দিন কথাকাটাকাটি কিংবা উচ্চবাচ্য হতে দেখিনি । বাবা কারী হিসেবে এতদঞ্চলে খ্যাত নামা ছিলেন । ভোরে আমার ঘুম ভাঙ্গতো বাবার কোরআন তেলাওয়াত শুনে শুনে । আমার মক্তবে বা মাদ্রাসায় কোরআন শিক্ষার কোন প্রয়োজনই পড়ে নাই । বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাবার তেলাওয়াত শুনেই আমি অনেক গুলো সুরা কেরাত মুখস্ত করে ফেলেছিলাম । রাতে বাবা যতক্ষন না ঘুমাতেন ততক্ষন সুর করে সুরা কেরাত পাঠ করে যেতেন । যা ছিল তার নিত্য দিনের অভ্যেস । তার পরও বাবা আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য পাশের গ্রামের এক মক্তবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন । বাবা নিজে মক্তবে দিয়ে আসতেন । বাবার সাথে অনেক সুখ দু;খের স্মৃতি আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় ভীড় করছে যার সবগুলো আমি লিখনির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারছিনা । বাবা ছিলেন একজন খ্যাতনামা সুফী পীরের মুরিদ । প্রতি বছর শীতকালে তার বাড়ীতে মুরিদানদের আসর বসতো । বাবা সেখানে তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে নিয়মিত যেতেন । যা ছিল আমাদের এখান থেকে বহুদুর । খুব ভোরে ফজরের নামাজ শেষে রওয়ানা দিতেন সদলবলে । আমি যেতে চাইতাম বলে লুকিয়ে তারা বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতেন আমায় ফাঁকি দিয়ে । আমিু ঘম থেকে উঠে বাবাকে খোঁজতাম সারাবাড়ী । যখন জানতাম বাবা পীরের বাড়ী চলে গিয়েছে তখন কাঁদতাম দিনমান ধরে আর বাবা ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকতাম নাওয়া খাওয়া ভুলে। বাবা ফিরলে তবেই ছিল আমর শান্তি । আমি বাবার এতই লাগুয়া ছিলাম যে বাবা গোসলের সময় আমাকে নিজ হাতে গোসল করিয়ে তবেই নিজে গোসল সারতেন । খাবার বেলায় লুকমা তুলে খাইয়ে দিয়েছেন প্রায় দশ বছর বয়স পর্যন্ত ।
বাড়ীর আর সবাই জানতো বাবা আমাকে আর বড় ভাইকে বেশী স্নেহ করেন । বড় ভাইজান আমার জন্মের আগেই এইচএসসি পাশ করে সরকারী চাকরী নিয়ে সুদুর খুলনায় থাকতেন । বড়ভাইজানের অবর্তমানে আমিই ছিলাম তার সবচেয়ে কাছের সবেধন নীলমনি । ভাইজান বাড়ী এলে বাবা আমাদের দুজনকে নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতেন মোরগীর বাচ্চার মত বগল দাবা করে । উনার সুখী সুখী ভাব দেখে মনে হতো উনার জীবন যেন সার্থক দুজনকে কাছে পেয়ে । আমার বয়স তখন নয়দশ হবে । জমি থেকে বর্ষার পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে । জমিতে হাল দিয়ে রোয়া বুনতে হবে । বাবা জমিতে কামলা লাগিয়ে ধানের চাড়া রোপন করতে বললেন । মেঝো দু ভাই ধানের চাড়া ছাড়িতে আনতে ব্যস্ত । বাবা আমায় বলল কিছুক্ষন পর গিয়ে জমিতে কামলাদের খাবার পানি ও তামাক দিয়ে আসতে । বলে তিনি আরঙে (বাজারে) চলে গেলেন । আমি বাবার আদেশের কথা ভুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরতে চলে গেলাম । অন্য দু ভাই এসে দেখে কামলারা কাজ ফেলে বসে আছে । জানা গেল পানি পিপাসায় ও তামাক খেতে না পেয়ে তারা কাজ করতে পারছে না । বাবা শুনে তো অগ্নিশর্মা । অনেক খুঁজে মাঝ বিলে আমায দেখতে পেলেন আমি বন্ধুদের সাথে মাছ ধরছি । বাবা খুব আদর করে আমায় ডেকে আনলেন । আমি উঠে এলাম বাবা পরম যত্নে আমায় হাত ধরে বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলেন । কিছুদুর এসে বাশঝাড় থেকে একটা কঞ্চি যোগার করে আমায় সপাং সপাং করে পেটাতে শুরু করলেন । আমিতো অবাক ! এই আমার জীবনে প্রথম ও শেষ বাবার হাত মার খাওয়া । যা মনে হলে এখন আমার হাসি পায় । বাবা সবসময় আমাদের সব ভাইদের বলতেন শুন বাবারা আমি গ্রামের মসজিদের ইমাম ও গ্রাম্য শালিশের বিচারক । কোন দিন যেন আমার কাছে আমার কোন সন্তানের নামে শালিশ না আাসে । আরও বলতেন আমার সংসারে কোন দিন যেন অসথ পথে উপার্জিত রোজগার প্রবেশ না করে সে কথা মনে রাখবে ? আমরা সবাই বাবার কথা গুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে এসেছি আজও তা মেনে চলার চেষ্টা করি । সেজন্য গ্রামে আমার বাবার সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে বেশ সুনাম ছিল যা আজও টিকে আছে । দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে । আমার বড় জন যিনি ঢাকায় বড় ভাইজানের বাসায় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছেন । বড় ভাইজান তার পরিবার সহ ঢাকায় অবস্থান করছেন । বাড়ীতে মেঝো দুভাই, তাদের স্ত্রী, মা, বাবা আর আমি । আশ্বিন মাস বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে । আমাদের বাড়ীটি ঢাকা চট্টগ্রাম রেললাইনের পাশে । রাতে মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইনে ডিনামাইট ফিটকরে এম্ভোস নিয়ে অপেক্ষা করছে ট্রেন উড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে । সকালে জানতে পেরে গ্রামের মানুষ যে যেদিকে পারে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে । বাবা বাড়ীর সবাইকে নিরাপদ আশ্রযের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বাড়ী পাহাড়ায় থেকে গেলেন । কিছুদুর গিয়ে আমি বাবাকে দেখতে না পেয়ে কাউকে না জানিয়ে আমি আবার বাড়ী ফিরে এলাম । বাবা আমাকে দেখে রাগ না করে বরং খুশীই হলেন বলে মনে হলো । দুপুর একটা হবে বাবা আমাদের দুজনের খাবারের জন্য সকালের তরকারীটা গরম করার জন্য রান্নাঘরে ব্যস্ত । এদিকে মসজিদে আজান দেবে এমন কেউ গ্রামে নেই । বাবা বললো তুই গোসলটা সেরে নে আমি তরকারীটা উঠিয়েই গোসল করে নামাজ পড়ে খেতে বসবো । এদিকে পাক আর্মির সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছে । বাবা কোন রকমে তরকারীর পাতিলটা মুল ঘরে রেখে দিয়ে আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন । আমার পড়নে একটা ইংলিশ প্যান্ট ও সেন্ডু গেঞ্জি । বাবার পড়নে একটা লুঙ্গি ও গায়ে পাতলা একখান ফতুয়া । ঘর থেকে আর কোন কাপড় নেবার সময পেলাম না । বাড়ীর সামনে বেড়িয়ে দেখি পাক আর্মিরা বৃষ্টির মত বড় রাস্তার দিকে গুলি করছে । গ্রামে আমাদের মত দুএক জন যারা ছিল তারা পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে কাদা পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে । বাবা আমাকে নিয়ে গ্রামের দক্ষিন দিকে ছুট লাগালেন । আমাদের গ্রামটি উত্তর দক্ষিনে লম্বালম্বি ভাবে বিস্তৃত । উত্তর সীমানায় রেল লাইন । গাছের ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে পাক আর্মিরা ট্রেন বোঝাই করে এসে গ্রামের নিরীহ সাধারনের উপর আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে । আমরা পাক আর্মিদের চোখ ও গুলি থেকে নিজেদের বাচিয়ে গ্রামের শেষ মাথায় এসে পৌছালাম । আর পালাবার পথ নেই । সামনে তিন দিকেই বিল । বর্ষার পানিতে বিল টইটুম্বুর । সুদিনের চোট্ট বিল এখন যেন একটি ভরা নদীতে রূপান্তরিত হয়ে আছে । অনেকেই সাতরিয়ে বিল পাড়ি দিতে শুরু করেছে । বাবা আমাকে জোড় করে তাদের সাথে সাতার দিতে বললেন । আমি প্রথমে বাবাকে ছেড়ে যেতে রাজি না হওয়ায় ধমক লাগালেন । শেষ পর্যন্ত বাবার জোড়াজুড়িতে আমাকে সাতরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতেই হলো । নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলাম পাক হায়েনারা আমাদের পুরো একমাইল ব্যাপি গ্রামটির প্রতিটি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে । আর সামনে কোন মানুষজন পেলেই পাখি শিকারের মত গুলি করে উল্লাস করে উঠছে । প্রায় চারঘন্টা কয়েকটি গ্রামে তান্ডব চালিয়ে সন্ধ্যার আগ মূহুর্তে পাকসেনারা গ্রাম ছেড়ে ভৈরবে ফিরে গেল । আমি সহ গ্রামের অনেক লোক নিরাপদ আশ্রয় থেকে বাড়ী ফিরে এলাম । কোথায় বাড়ী এ যে আগুনে পোড়ে ছাইসর্বস্ব একটি প্রাচীন জনপদ । নিজের বাড়ীই নিজে খুজে পাচ্ছি না । আমাদের বাড়ীর পেছনে সদ্য নির্মিত পাকা টয়লেটটি দেখে আমাদের বাড়ীটি চিনতে পারলাম । পৌছে দেখি বাবা আমার আগেই বাড়ী পৌছে গোলায় পুড়ে যাওয়া ধান গুলোকে বাচাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন । আমাকে দেখতে পেয়েই বাবা দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে ঝড় ঝড় করে কেদে ফেললেন । বাবাকে জড়িয়ে ধরে আমিও অনেক ক্ষণ কাদলাম । এদিকে গোলার ধান গুলি তোষের আগুনের মত ঘোষে ঘোষে জ্বল ছে তো জ্বলছে । যতই বালতি ভর্তি পানি ঢালছেন ততই যেন আরও ধিকি ধিকি জ্বলে উঠছে । বাবার কাছ থেকে জানতে পারলাম তিনি আমন ধান ক্ষেতের ভেতর প্রবেশ করে নাক জাগিয়ে কচুরীপানা মাথায় দিয়ে লুকিয়ে জান বাচিয়েছেন । বাবার লুকিয়ে থাকার অবস্থান থেকে মাত্র একশত মিটার দুরে গ্রামের শেষ বাড়ীটি জ্বালিয়ে দিয়ে সে বাড়ীর এক বৃদ্ধা মহিলাকে ধরে এনে বিলের পাড়ে বাবার চোখের সামনে গুলি করে ফেলে রেখে গিয়েছে । বাবা ভয়ে দম বন্ধ করে মরার মত কচুরী পানার ভেতর পড়ে ছিলেন প্রায় তিন ঘন্টা । সকাল থেকেই আমরা দুজন না খাওয়া । এর মাঝে মৃত্যু ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়া দৌড়ির ফলে শরীর বিষন্ন অবসন্ন । রাত হয়ে গিয়েছে ক্ষিধের জ্বালায় শরীর অবশ হয়ে আসছে ্ বাবাকে বলতেই বাবা দ্রুত ঘরের পোড়া টিন সরিয়ে ঘরের মাটির মাচায় রক্ষিত রেক থেকে পোড়া ভাতের হাড়ি ও মাছের তরকারীর হাড়িটি খুজে আনলেন । হাড়িতে রক্ষিত ভাত ও মাছ পোড়ে কয়লা হয়ে আছে । উপর থেকে ময়লা সরিয়ে বাবা আমাকে পোড়া ভাত তরকারী খেতে বললেন । ক্ষিধায় এতটাই কাতর ছিলাম যে সেই পোড়া ভাত অমৃতের মত গোগ্রাসে গিলে সেদিন বাবা ছেলে দুজনেই প্রান বাচিয়ে ছিলাম । দেশ স্বাধীন হলো আমাদের কে আবার ঘরবাড়ী, কাপড়চোপর, সংসারে টুকিটাকি হাড়িপাতিল থেকে শুরু করে সব কিছু নতুন ভাবে কিনে জীবন শুরু করতে হলো । বাপ দাদার ঐতিহ্য বলে যে একটি পরিবারে কিছু জিনিষ থাকে তার চিহ্ন মাত্র আমাদের ছিল না । গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষ সরকারী সাহায্য সহযোগিতা পেলেও আমাদের মত পাচটি পরিবার একটু সচ্ছল বিধায় কোন রূপ সহায়তাই পেল না । তাতেও বাবার কোন আক্ষেপ কোনদিন চোখে মুখে দেখিনি । মাঝে মাঝে আমি সহ অন্য ভাইয়েরা এ বিষয়ে দুএক কথা বললেও বাবা বলতেন অন্যের দানের আশা না করে নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বি হও দেখবে এতে অনেক সুখ । বাবার এ কথাটা আজও আমার মনে দাগ কেটে আছে । আমি অস্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উঠেছি । ক্লাসের অন্যবন্ধুদের দেখা দেখি বিঞ্জান নিয়ে পড়বো বলে মনস্থির করলাম । মনে বড় আশা ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার হবো । আসলে ডবলঙ্কা । বাবা বললেন তুমি যা পারবে যতটুকু পারবে মাথায় ততটুকু বোঝাই নিও এর বেশী নয়, নইলে ঘাড় মটকিয়ে ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা থাকে । কে শুনে কার কথা । সব বন্ধুরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবে আর আমি পড়ে থাকবো পেছনে এ কি করে হয় ? এতদিন পর্যন্ত বাবাই আমাকে বই খাতা কিনে দিয়েছে । বিঞ্জানের জন্য প্র্র্যাকটিক্যাল খাতা কিনতে হবে । বাবা হুজুর মানুষ এসব বুঝবে না । মা’ এর কাছ থেকে লুকিয়ে কিছু টাকা জোগার করে বাবাকে না জানিয়ে একদিন খুব ভোরের ট্রেনে বন্ধুরা মিলে নরসিংদী চলে এলাম । নরসিংদী এসে লাইব্রেরী ঘুরে ঘুরে তিনটি প্র্যাকটিক্যাল খাতা ও দুটি বিঞ্জানের বই কিনে ফেললাম । হাতে তখনো পাঁচ টাকা পড়ে আছে । এক বন্ধু বললো বাড়ী ফেরার ট্রেন সেই সন্ধ্যা সাতটায় । এখন আমরা কি করি । হাতে অফুরন্ত সময় । হেটে বাড়ী যাবো তাও সম্বব নয় কারন নরসিংদী থেকে বাড়ীর দুরত্ব প্রায় পনের বিশ মাইল । যাবার অন্য কোন বাহন নেই । হঠাৎ এক জনের মাথায় কুবুদ্ধি এল । চল কম খরচে খেয়ে পয়সা বাচিয়ে সিনেমা দেখে আসি । তাতে সময়ও কাটবে সিনেমাও দেখা হয়ে যাবে । যেই কথা সেই কাজ । নরসিংদী বাজারে ঢুকে আটার রুটি আর আখের গুড় দিয়ে চার জনে মাত্র পাঁচ টাকা খরচ করে পেট পুড়ে দুপুরের খাবার সারলাম । খেয়ে সিনেমা হলের কাছে গিয়ে হাজির হলাম । সিনেমা শুরু হতে তখনো অনেক বাকী । আড়াইটার দিকে মাত্র পঞ্চাশ পয়সা করে প্রথম শ্রেণীর চারটি টিকিট কিনে হলে প্রবেশ করলাম । হল থেকে সিনেমা শেষে বেড়িয়ে দেখি প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে । দ্রুত স্টেশনের দিকে হাটা দিলাম । স্টেশনে এসে দেখি ট্রেন আসতে আরও অনেক সময় বাকী । অগত্যা স্টেশনে ঘুরঘুর করতে থাকলাম । সাতটা বেজে গেছে ট্রেনের খবর নাই । জানা গেল ট্রেন আসতে আধা ঘন্টা লেট হবে । এদিকে রাত হয়ে গেছে বাবার কথা মনে পড়ছে । নিশ্চয় বাবা এতক্ষনে জেনে গেছে । আজ আর রক্ষে নেই । বাড়ী গিয়ে মারতো খেতে হবেই সাথে না বাড়ী থেকে বেরই করে দেয় সে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠছি । ট্রেন এলো হুরমুর করে উঠে পড়লাম । ট্রেনে তিল ধারনের ঠাই নাই । চাপাচাপি করে কোন রকমে বই খাতা গুলো বগল দাবা করে এক কোনায় দাড়িয়ে ঘামতে থাকলাম । দুটো স্টেশন পার হবার পর ট্রেনের ভীর অনেকটা কমে এল । সিট নিয়ে বসে পড়লাম । আমাদের স্টেশনে যখন নামলাম রাত তখন দশটা । বাইরে গুদঘুটে অন্ধকার । চার বন্ধূ হাত ধরাধরি করে রেললাইনের উপর দিয়ে হাটছি । সামনে থেকে কে যেন একটা হারিকেন হাতে নিয়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে আসছে । কাছে আসতেই দেখলাম হারিকেন নিয়ে আর কেউ না আমার বাবা । বিঞ্জান নিয়ে পড়তে গিয়ে এস এসসিতে খুব একটা ভাল ফলাফল করা গেল না । বড় ভাইজান রাগ করে বাবাকে বলল ওকে স্থানীয় কলেজে ভর্তি করিয়ে দিন । সে আপনার আদরে আদরে উচ্ছন্নে গেছে ওকে দিয়ে ভাল কিছূ আশা করা যায় না । বাবা ভাইজানের এ কথায় মনে বেশ কষ্ট পেলেন । আমাকে তাই বাধ্য হয়ে বিঞ্জান ছেড়ে দিয়ে মানবিক শাখায় স্থানীয় কলেজে ভর্তি হতে হলো । এইচ এসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম । বড় ভাইজানের বাসায় কিছুদিন থাকলাম । নিজের চেষ্টায় হলে সিট জোগার করে হলে উঠে এলাম । বাবা আমার এ সাফল্যের খবর জেনে আলতু করে পিঠ চাপরে দিলেন । উনিশ আশি সাল বাবা দিনে দিনে অসুস্থ হয়ে পড়লেন । ডায়াবেটিস ধরা পড়লো । বয়স তখন তার আশি । বড়ভাই জান চাকরী সূত্রে তখন আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি ভৈরবে পোষ্টিং । বাবা চিকিৎসার জন্য ঢাকায় থাকতে রাজি হলেন না । বাড়ীতে থাকলেন । বড় ভাইজান দু একদিন পরপর বাড়ী গিয়ে বাবাকে দেখে আসেন । উনার পুরো পরিবার ঢাকায় । সপ্তাহে পনের দিনে ঢাকায় আসেন । বড় ভাই এর বড় ছেলেটি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । আমি হল থেকে মাঝে মাঝে ঢাকার বাসার খোজ খবর নেই । ভালই চলছিল হঠাৎ একদিন খবর পেলাম বাবার অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন । তারিখটা অক্টোবরের পাচ । আগামীকাল আমার টিউটরিয়েল পরীক্ষা । বাবার খবর শুনতে পেয়ে আর বিলম্ব না করে দুপুরের মেল ট্রেন ধরে বাড়ীর পথে রওযানা হলাম ।আমি যখন বাড়ী পৌছালাম তখন সব শেষ । গিয়ে দেখি বাবাকে সাদা কাফনে ঢেকে সবাই আমার ও চতুর্থ ভাই এর জন্য অপেক্ষা করছেন । অল্পক্ষনের মাঝেই তিনিও এসে গেলেন । আমরা তিন ভাই মিলে বাবাকে শেষ অন্তিম শায়ানে রেখে এলাম । বাবাকে কবরে রেখে ঘরে এসে মা এবং ভাবীদের কাছে জানতে পারলাম বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত শুধু আমারই অপেক্ষা করে মাকে বারবার দরজার দিকে ইশারা করেছেন । মা মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন ওকে খবর পাঠানো হয়েছে এই এলো বলে । আমার জীবনে সবচেয়ে বড় দু:খ বাবার মৃত্যুর সময় আমি পাশে থাকতে পারিনি । বাবা আমাকে ক্ষমা করো তোমার এত স্নেহ এত আদরের মূল্য আমি রাখতে পারিনি বলে । আমাকে ক্ষমা করো বাবা, আমাকে ক্ষমা করো । বাবা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন আজ প্রায় তেত্রিশ বছর হতে চলছে । কিন্তু বাবার কথা মনে হলেই মনে হয় এইতো সেদিনের কথা । বাবা যেন আজও আমায় তেমনি দেখছেন তেমনি আমার অপেক্ষায় পথ পানে চেয়ে আছেন । জান বাবা আজ আমিও তোমার মত বাবা হয়েছি । আমার ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । আমিও তোমার মত আমার সন্তান কে আগলে রাখতে চেষ্টা করি । ঘর হতে বের হলে ছেলেটার জন্য মনটা যেন কেমন মোচড় দিয়ে উঠে । ঘরে না ফেরা পর্যন্ত বার বার পথপানে চেয়ে থাকি যেমনটি তুমি আমার জন্য করতে । সেদিন তোমার সেই উতলা ভাবটা আমাকে বিরক্ত করতো কিন্তু আজ আমি নিজে বাবা হয়ে বুঝতে পারছি কেন তুমি এমনটি করতে । জান বাবা আমি আজ ও তোমার উপদেশ সমুহ মেনে চলছি । আমি পরিবারে বা অন্য কারো বিন্দু মাত্র সহযোগিতা ছাড়াই নিজের পায়ে দাড়িয়েছি । আমি তোমার রেখে যাওয়া সম্পদ একটুও নষ্ট না করে তা যেমন ছিল তেমনি রেখে দিয়েছি । যখন কোন কারনে আমার খুব মন খারাপ হয় তখন পুরোনো এলবামটা বের করে বাবা তোমার ছবিটা দেখি আর গুনগুন করে গাইতে থাকি – তুমি কি কেবলই ছবি শুধু পটে লেখা ঐ যে সুদুর নিহারিকা যারা করে আছে ভীর আকাশের নীড়, ঐ যারা দিন রাত্রি আলো হাতে চলিয়াছে আধারেরও যাত্রী গ্রহ তারা রবির--- আর নিরবে তোমার কথা মনে মনে জপতে থাকি আমার মন ভাল হযে যায় । আমার সন্তানকেও তোমার দেওয়া উপদেশ সমুহ মেনে চলার জন্য নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি । আমার মনে হয় আমি তোমার মত কিছুটা হলেও সফল হবো বাবা ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফেরদৌসী বেগম (শিল্পী )
আপনার বাবাকে নিয়ে হৃদয়বিদারক এই গল্পটি পড়ে, সত্যিই আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছি। আপনার বাবার প্রতি রইলো শ্রদ্ধা। কামনা করছি, আপনার ছেলেরাও যেন তাদের বাবাকে, ঠিক আপনার মতই অনুভব করতে পারে।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
গভীর আবেগের মানুষ বলে কেউ যদি আমাকে 'বোকা' বলে ক্ষেপাতে চায় , তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারণ- এত বেশি আবেগ আছে বলেই আমি ভীষণ ভালো একজন মানুষ। আপনার বাবা-কাহিনী পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি, আবেগে আপ্লুত হয়েছি, কেঁদে নাকের চোখের জল এক করেছি।
তানি হক
শেষের দিকে এসে চোখে পানি ধরে রাখতে পারলাম না বশীর ভাই ... একজন পিতা ...আমদের সবার পিতার গল্প শুনালেন ... আল্লাহ্ উনাকে জান্নাত বাসি করুন ... আর লিখার শেষের দিয়ে যে দুটি লাইন লিখেছেন তা মনের গভীরে গেঁথে নিলাম ... খুব ভালো লাগলো ওনেক দিন পড়ে আপনার লিখা পেয়ে খুব আনন্দিত হলাম ... ধন্যবাদ ও সালাম ভাইয়া
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।